শব্দের শ্রেণীবিভাগ (পর্ব ১):
শব্দের উৎপত্তিগত শ্রেণীবিভাগ
বাংলা ভাষার উৎপত্তি
তৎসম শব্দ
অর্ধ-তৎসম শব্দ
তদ্ভব শব্দ
দেশি শব্দ
বিদেশি শব্দ
আরবি শব্দ
ফারসি শব্দ
ইংরেজি শব্দ
পর্তুগিজ শব্দ
ফরাসি শব্দ
ওলন্দাজ শব্দ
গুজরাটি শব্দ
পাঞ্জাবি শব্দ
তুর্কি শব্দ
চিনা শব্দ
মায়ানমার/ বর্মি শব্দ
জাপানি শব্দ
মিশ্র শব্দ
শব্দের গঠনমূলক শ্রেণীবিভাগ
মৌলিক শব্দ
সাধিত শব্দ
অর্থমূলক শ্রেণীবিভাগ
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
ব্যবহারিক অর্থ
যৌগিক শব্দ
রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ
যোগরূঢ় শব্দ
নবসৃষ্ট বা পরিশব্দ বা পারিভাষিক শব্দ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত বছরের প্রশ্ন
শব্দের উৎপত্তিগত শ্রেণীবিভাগ
বাংলা ভাষার শব্দকে উৎপত্তিগত দিক দিয়ে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ৫টি বিভাজন সম্পর্কে জানার আগে বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য জানা জরুরি।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি:বাংলা ভাষার উৎপত্তি মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে। এই বংশের অন্যতম একটি শাখা সংস্কৃত। বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার বংশেরই উত্তরসূরী। কিন্তু বাংলা ভাষা সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে আসেনি। সংস্কৃত সবসময়েই ছিলো সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষদের ব্যবহৃত ভাষা। আর বাংলা শুরু থেকেই সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের ভাষা। এ থেকেই বোঝা যায় সংস্কৃত আর বাংলার মাঝেও কোনো ভাষা ছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাষাবিদেরা একমত হতে পারেননি। পূর্বে সম্ভ্রান্ত মানুষেরা সংস্কৃত ব্যবহার করতো। আর সাধারণ মানুষ যে সব ভাষায় কথা বলতো, সেগুলোকে বলা হতো প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষা। অপভ্রংশ মানে বিকৃত, সংস্কৃত ভাষার শব্দকে মানুষ পরিবর্তন করে তাদের সুবিধামতো করে উচ্চারণ করতো বলে এগুলোকে পন্ডিতরা বলতেন অপভ্রংশ বা বিকৃত ভাষা। এগুলো আঞ্চলিক ভাষার মতোই একেক জায়গায় ছিলো একেক রকম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা এসেছে গৌড়ীয় প্রাকৃত বা অপভ্রংশ থেকে। আর ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলা এসেছে মাগধী অপভ্রংশ থেকে। এই অপভ্রংশগুলোতে সংস্কৃত ভাষার যে পরিবর্তিত বা বিকৃত রূপ পাওয়া যায়, তারই আরো পরিবর্তিত আর সহজ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় বাংলা ভাষা। দিন দিন মানুষের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা ভাষাও অনেক সহজ হয়ে এসেছে। এবং তা আরো পরিবর্তিত হয়ে দিন দিন আরো সহজ ও সংক্ষিপ্ত হবে। পাশাপাশি নতুন নতুন প্রয়োজনে আরো অনেক নতুন শব্দও তৈরি হবে বা অন্য ভাষা থেকে আমাদের ভাষায় ঢুকে যাবে।
উৎপত্তিগত দিক দিয়ে শব্দের ৫টি বিভাজন হলো- তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি আর বিদেশি শব্দ।
তৎসম শব্দ:সংস্কৃত ভাষার যে সব শব্দ প্রাকৃত বা অপভ্রংশের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়নি, বরং সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সে সব শব্দকেই বলা হয় তৎসম শব্দ। উদাহরণ- চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র,
অনেক তৎসম শব্দেরই অর্ধ-তৎসম ও তদ্ভব রূপও বাংলায় ব্যবহৃত হয়। যেমন, সূর্য˃ সুরুয, মনুষ্য˃ মানুষ।
শুধু তৎসম শব্দেই ষ, ণ ব্যবহৃত হয়।
অর্ধ-তৎসম শব্দ:যে সব সংস্কৃত শব্দ কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম। এগুলো সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকেই কিছুটা সহজ আকারে গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষার মাধ্যমে বাংলায় আসেনি। যেমন, জ্যোৎস্না˂ জ্যোছনা, শ্রাদ্ধ˂ ছেরাদ্দ, গৃহিণী˂ গিন্নী, বৈষ্ণব˂ বোষ্টম, কুৎসিত˂ কুচ্ছিত।
তদ্ভব শব্দ:বাংলা ভাষা গঠনের সময় প্রাকৃত বা অপভ্রংশ থেকে যে সব শব্দ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছিলো, সেগুলোকেই বলা হয় তদ্ভব শব্দ। অবশ্য, তদ্ভব শব্দের মূল অবশ্যই সংস্কৃত ভাষায় থাকতে হবে। অর্থাৎ, যে সব শব্দ সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃত বা অপভ্রংশে ব্যবহৃত হয়েছিলো, পরে আবার প্রাকৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকেই বলা হয় তদ্ভব শব্দ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস থেকেই বোঝা যায়, মূলত এই শব্দগুলোই বাংলা ভাষা গঠন করেছে। আর তাই এই শব্দগুলোকে বলা হয় খাঁটি বাংলা শব্দ। যেমন, সংস্কৃত ‘হস্ত’ শব্দটি প্রাকৃততে ‘হত্থ’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর বাংলায় এসে সেটা আরো সহজ হতে গিয়ে হয়ে গেছে ‘হাত’। তেমনি, চর্মকার˂ চম্মআর˂ চামার,
দেশি শব্দ:বাংলা ভাষাভাষীদের ভূখণ্ডে অনেক আদিকাল থেকে যারা বাস করতো, সেইসব আদিবাসীদের ভাষার যে সব শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সে সব শব্দকে বলা হয় দেশি শব্দ। এই আদিবাসীদের মধ্যে আছে- কোল, মুণ্ডা, ভীম, ইত্যাদি। মেমন,কুড়ি (বিশ)- কোলভাষা, পেট (উদর)- তামিল ভাষা, চুলা (উনুন)- মুণ্ডারী ভাষা।
বিদেশি শব্দ:বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা অন্য ভাষাভাষীর মানুষের সংস্পর্শে এসে তাদের ভাষা থেকে যে সব শব্দ গ্রহণ করেছে, বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে অন্য ভাষার শব্দ গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় বিদেশি শব্দ। যে কোনো ভাষার সমৃদ্ধির জন্য বিদেশি শব্দের আত্মীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এদিক দিয়ে বাংলা ভাষা বেশ উদারও বটে।
আরবি শব্দ :আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওযু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গোসল, জান্নাত, জাহান্নাম, হওবা, হসবি, যাকাত, হজ, হাদিস, হারাম, হালাল
আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মোক্তার, রায়
ফারসি শব্দ:খোদা, গুনাহ, দোযখ, নামায, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রোযা
কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান,দস্তখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, মেথর, রসদ
আদমি, আমদানি, জানোয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাস, রফতানি, হাঙ্গামা
ইংরেজি শব্দ: প্রায় অপরিবর্তিত উচ্চারণে- চেয়ার, টেবিল
পরিবর্তিত উচ্চারণে- আফিম (opium), ইস্কুল (school), বাক্স (box), হাসপাতাল (hospitai), বোতল (bottle)
পর্তুগিজ শব্দ :আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি
ফরাসি শব্দ : কার্তুজ, কুপন , ডিপো, রেস্তোঁরা
ওলন্দাজ শব্দ : ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন (তাসের নাম)
গুজরাটি শব্দ : খদ্দর, হরতাল
পাঞ্জাবি শব্দ : চাহিদা, শিখ
তুর্কি শব্দ : চাকর, চাকু, তোপ, দারোগা
চিনা শব্দ : চা, চিনি, লুচি
মায়ানমার/ বর্মি শব্দ : ফুঙ্গি, লুঙ্গি
জাপানি শব্দ :রিক্সা, হারিকিরি