সমাস (পর্ব ২):
কর্মধারয় সমাস মূলত ৪ প্রকার-
মধ্যপদলোপী কর্মধারয়:যে কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তী পদগুলো লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন, ‘স্মৃতি রক্ষার্থে সৌধ = স্মৃতিসৌধ’। এখানে ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তী পদ ‘রক্ষার্থে’ লোপ পেয়েছে। পূর্বপদ ‘স্মৃতি’ এখানে বিশেষণ ভাব বোঝাচ্ছে। আর ‘সৌধ’ বিশেষ্য। এটিরই অর্থ প্রধান। সুতরাং এটি মধ্যপদলোপী কর্মধারয়।
(উপমান ও উপমিত কর্মধারয় সমাস আলাদা করে চেনার আগে কতোগুলো সংজ্ঞা/ টার্মস জানা জরুরি। সেগুলো হলো- উপমান, উপমেয় ও সাধারণ ধর্ম।কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর সঙ্গে তুলনা করা হলে যাকে তুলনা করা হলো, তাকে বলা হয় উপমেয়। আর যার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে বলে উপমান। আর উপমেয় আর উপমানের যে গুণটি নিয়ে তাদের তুলনা করা হয়, সেই গুণটিকে বলা হয় সাধারণ ধর্ম। যেমন, ‘অরুণের ন্যায় রাঙা প্রভাত’। এখানে ‘প্রভাত’কে ‘অরুণ’র মতো ‘রাঙা’ বলে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং, এখানে ‘প্রভাত’ উপমেয়। উপমান হলো ‘অরুণ’। আর প্রভাত আর অরুণের সাধারণ ধর্ম হলো ‘রাঙা’।)
উপমান কর্মধারয় সমাস:সাধারণ ধর্মবাচক পদের সঙ্গে উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। অর্থাৎ, উপমান ও উপমেয় কর্মধারয়ের মধ্যে যেটিতে সাধারণ ধর্মবাচক পদ থাকবে, সেটিই উপমান কর্মধারয়। যেমন, তুষারের ন্যায় শুভ্র = তুষারশুভ্র। এখানে ‘তুষার’র সঙ্গে কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে তুলনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ এটি উপমান। আর সাধারণ ধর্ম হলো ‘শুভ্র’। উপমেয় এখানে নেই। সুতরাং, এটি উপমান কর্মধারয় সমাস।
উপমিত কর্মধারয় সমাস:উপমেয় ও উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। এই সমাসে সাধারণ ধর্ম উল্লেখ করা থাকে না। অর্থাৎ, উপমান ও উপমিত কর্মধারয়ের মধ্যে যেটিতে সাধারণ ধর্মবাচক পদ থাকবে না, সেটিই উপমিত কর্মধারয় সমাস। যেমন, ‘পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ’। এখানে ‘পুরুষ’কে ‘সিংহ’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ‘পুরুষ’ উপমেয় আর ‘সিংহ’ উপমান। সাধারণ ধর্মের উল্লেখ নেই। সুতরাং, এটি উপমিত কর্মধারয় সমাস।
রূপক কর্মধারয় সমাস:উপমান ও উপমেয় পদের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করা হলে, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এটির ব্যাসবাক্যে উপমেয় ও উপমান পদের মাঝে ‘রূপ’ শব্দটি অথবা ‘ই’ শব্দাংশটি ব্যবহৃত হয়। যেমন, ‘মন রূপ মাঝি = মনমাঝি’। এখানে ‘মন’ উপমেয় ও ‘মাঝি’ উপমান। কিন্তু এখানে তাদের কোন নির্দিষ্ট গুণের তুলনা করা হয়নি। মনকেই মাঝি হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে।
তৎপুরুষ সমাস
যে সমাসে পূর্বপদের শেষের বিভক্তি লোপ পায়, এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। পূর্বপদের যে বিভক্তি লোপ পায়, সেই বিভক্তি অনুযায়ী তৎপুরুষ সমাসের নামকরণ করা হয়। তবে মাঝে মাঝে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ না পেয়ে অবিকৃত থেকে যায়। তখন সেটাকে বলা হয় অলুক তৎপুরুষ। (অলুক মানে লোপ না পাওয়া, অ-লোপ)।
যেমন, দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত। এখানে পূর্বপদ ‘দুঃখ’র সঙ্গে থাকা দ্বিতীয়া বিভক্তি ‘কে’ লোপ পেয়েছে। আবার পরপদ ‘প্রাপ্ত’র অর্থই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখ প্রাপ্ত হয়েছে বলেই নতুন শব্দের প্রয়োজন হয়েছে, যার জন্য বাক্যাংশটিকে সমাস করে নতুন শব্দ বানানো হয়েছে। অর্থাৎ, এখানে পূর্বপদের শেষের বিভক্তি লোপ পেয়েছে, এবং পরপদের অর্থের প্রাধান্য রক্ষিত হয়েছে। তাই এটি তৎপুরুষ সমাস।
বহুব্রীহি সমাস
যে সমাসে পূর্বপদ বা পরপদ কোনটিরই অর্থের প্রাধান্য রক্ষিত হয় না, বরং সমস্ত পদ তৃতীয় কোন শব্দকে বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন, মহান আত্মা যার = মহাত্মা। এখানে পূর্বপদ ‘মহান’ (মহা) ও পরপদ ‘আত্মা’। কিন্তু সমস্ত পদ ‘মহাত্মা’ দ্বারা মহান বা আত্মা কোনটাকেই না বুঝিয়ে এমন একজনকে বোঝাচ্ছে, যিনি মহান, যার আত্মা বা হৃদয় মহৎ। আবার, মহাত্মা বলতে মহাত্মা গান্ধীকেও বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু কোন অর্থেই পূর্বপদ বা পরপদকে বোঝানো হচ্ছে না। অর্থাৎ, পূর্বপদ বা পরপদ, কোনটারই অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে না। সুতরাং, এটি বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ।
(উল্লেখ্য, বহুব্রীহি সমাস, বিশেষ করে কিছু ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস ও উপপদ তৎপুরুষ সমাসের সমস্ত পদ প্রায় একই ধরনের হয়। ফলে এদের সমস্ত পদ দেখে আলাদা করে চেনার তেমন কোন উপায় নেই। এগুলোর সমাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাই একই ব্যাসবাক্য ও সমাস নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর পরীক্ষায় মূলত এগুলো উপপদ তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ হিসেবেই আসে।)
দ্বিগু সমাস
দ্বিগু সমাসের সঙ্গে কর্মধারয় সমাসের বেশ মিল রয়েছে। এজন্য একে অনেকেই কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভূক্ত করে থাকেন। দ্বিগু সমাসেও পরপদের অর্থই প্রধান। এবং এই সমাসেও বিশেষণ পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের সমাস হয়। তবে এখানে বিশেষণ পদটি সর্বদাই সংখ্যাবাচক হয়, এবং সমাস হয় সমাহার বা মিলন অর্থে।
অর্থাৎ, সমাহার বা মিলন অর্থে সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয়, এবং পরপদের অর্থই প্রাধান্য পায়, তাকে দ্বিগু সমাস বলে। যেমন, ‘অষ্ট ধাতুর সমাহার = অষ্টধাতু’। এখানে পূর্বপদ ‘অষ্ট’ একটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ। আর পরপদ ‘ধাতু’ বিশেষ্য। অষ্ট ধাতুর মিলন বা সমাহার অর্থে সমাস হয়ে ‘অষ্টধাতু’ সমস্ত পদটি তৈরি হয়েছে যাতে ‘ধাতু’ সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, পরপদের অর্থ প্রধান হিসেবে দেখা দিয়েছে। সুতরাং, এটি দ্বিগু সমাস।
অব্যয়ীভাব সমাস
সমাসের পূর্বপদ হিসেবে যদি অব্যয় পদ ব্যবহৃত হয়, এবং সেই অব্যয়ের অর্থই প্রধান হয়, তবে সেই সমাসকে বলা হয় অব্যয়ীভাব সমাস। যেমন, ‘মরণ পর্যন্ত = আমরণ’। এখানে পূর্বপদ হিসেবে পর্যন্ত অর্থে ‘আ’ উপসর্গ ব্যবহৃত হয়েছে। আর পরপদ ‘মরণ’। কিন্তু এখানে সমস্ত পদটিকে নতুন অর্থ দিয়েছে ‘আ’ উপসর্গটি। অর্থাৎ, এখানে ‘আ’ উপসর্গ বা অব্যয় বা পূর্বপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এটি অব্যয়ীভাব সমাস। (উপসর্গ এক ধরনের অব্যয়সূচক শব্দাংশ। উপসর্গ বচন বা লিঙ্গ ভেদে পরিবর্তিত হয় না কিংবা বাক্যের অন্য কোন পদের পরিবর্তনেও এর কোন পরিবর্তন হয় না। এরকম আরেকটি অব্যয়সূচক শব্দাংশ হলো অনুসর্গ।)