ভাষা, বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষারীতি (পর্ব ১):
ভাষা
বাগযন্ত্র
ধ্বনি
কণ্ঠধ্বনি
ভাষা
বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষারীতি
প্রমিত চলিত ভাষারীতি
আঞ্চলিক কথ্য রীতি
সাধু রীতি
ভাষারীতিগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা (ছক)
সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য (ছক)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত বছরের প্রশ্ন
ভাষা
ভাষার সংজ্ঞা বলার আগে আরো কিছু সংজ্ঞা জানা জরুরি।
বাগযন্ত্র: মানুষ কথা বলার সময় শরীরের যে সমস্ত অঙ্গ ব্যবহার করে, সেগুলোকেই একত্রে বাগযন্ত্র বলে। মানুষের বাগযন্ত্রের মধ্যে আছে- গলনালী, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, দন্ত বা দাঁত, নাসিকা বা নাক, ওষ্ঠাধর বা ঠোঁট, ইত্যাদি।
ধ্বনি: যে কোনো ধরনের আওয়াজকেই ধ্বনি বলা হয়। যেমন, মানুষের ভাষার ক্ষুদ্রতম ধ্বনি, বন্দুকের ধ্বনি, নূপুরের ধ্বনি, বজ্রপাতের ধ্বনি, গিটারের ধ্বনি, ড্রামসের ধ্বনি, কীবোর্ডে টাইপ করার ধ্বনি, ইত্যাদি।
কণ্ঠধ্বনি: মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে যে ধ্বনি সৃষ্টি করে, তাকে কণ্ঠধ্বনি বা ভাষণধ্বনি বলে। এটিই আমাদের ব্যাকরণের আলোচ্য ধ্বনি। ব্যাকরণে আমরা ‘ধ্বনি’ বলতে এই কণ্ঠধ্বনি বা ভাষণধ্বনিকেই বুঝিয়ে থাকি।
এই ধ্বনিই ভাষার মূল উপাদান।
ভাষা: বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকেই ভাষা বলে। এই ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন জাতির ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের জন্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। আবার বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে।
বর্তমানে পৃথিবীতে ভাষা আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি (৩৫০০-রও বেশি)।
বাংলা ভাষা
বাঙালি সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালি জাতি যে ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে, সেটিই বাংলা ভাষা।
ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর ৪র্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বর্তমানে, বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি।
বাংলা ভাষাভাষীরা থাকে- বাংলাদেশে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, এবং ভারতের ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, বিহার ও আসামের কিছু অংশে। তবে এখন প্রবাসী বাংলাদেশি ও প্রবাসী ভারতীয় বাঙালিদের কল্যাণে পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকে।
বাংলা ভাষারীতি
ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রতিটি মুহুর্তে ভাষা একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি ভাষাভাষী লোকজন তাদের ভাষার কঠিন শব্দটিকে পাল্টে সহজ করে নিচ্ছে, ছোট করে নিচ্ছে, আবার প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে নতুন নতুন শব্দ গ্রহণ করছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে নানা কৌশল প্রয়োগ করে নতুন নতুন শব্দও তৈরি করছে। এমনকি পুরোনো কোনো শব্দ নতুন অর্থে ব্যবহার করেও শব্দটির নতুন অর্থদ্যোতকতা তৈরি করে নতুন শব্দ তৈরি করা হচ্ছে। বাংলা ভাষায় এই কৌশলে নতুন অর্থপ্রাপ্ত বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ হচ্ছে- কঠিন ও চরম।
ভাষার এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একদিন অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিয়েছিলো আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা। আবার এই পরিবর্তনের কারণে বাংলা ভাষায় কিছু পৃথক ভাষারীতিও জন্ম নিয়েছে। বর্তমানে ব্যবহৃত বাংলা ভাষারীতি ২টি- আঞ্চলিক কথ্য রীতি ও প্রমিত চলিত ভাষারীতি।
প্রমিত চলিত ভাষারীতি:দেশের সকল মানুষ যে আদর্শ ভাষারীতিতে কথা বলে, যেই ভাষারীতি সকলে বোঝে, এবং যে ভাষায় সকলে শিল্প-সাহিত্য রচনা ও শিক্ষা ও অন্যান্য কাজকর্ম সম্পাদন করে, সেটিই প্রমিত চলিত ভাষারীতি। এই ভাষায় যেমন সাহিত্য সাধনা বা লেখালেখি করা যায়, তেমনি কথা বলার জন্যও এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। সকলে বোঝে বলে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে, যেমন কোনো অনুষ্ঠানে বা অপরিচিত জায়গায় বা আনুষ্ঠানিক (formal) আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে এই ভাষারীতি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, এই রীতি লেখ্য ও কথ্য উভয় রীতিতেই ব্যবহৃত হয়।
বাংলা প্রমিত চলিত ভাষারীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভাগীরথী-তীরবর্তী অঞ্চলের কথ্য ভাষার উপর ভিত্তি করে। তবে, পূর্বে এই ভাষা সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। তখন কেবল সাধু ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করা হতো। এ কারণে বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিকের ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ছোটগল্পকাররা সাধু ভাষায় উপন্যাস, নাটক ও গল্প লিখেছেন। পরবর্তীতে,প্রমথ চৌধুরীচলিত রীতিতে সাহিত্য রচনার উপর ব্যাপক জোর দেন এবং তাঁর‘সবুজপত্র’(১৯১৪) পত্রিকার মাধ্যমে চলিত রীতিতে সাহিত্য রচনাকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
আঞ্চলিক কথ্য রীতি:বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যে যে বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাকেই আঞ্চলিক কথ্য রীতি বা আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। সকল ভাষাতেই আঞ্চলিক ভাষা থাকে। এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলো কোনোভাবেই বিকৃত ভাষা নয়, এগুলো শুদ্ধ ও প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক ভাষারীতি।
প্রকৃতঅর্থে, প্রমিত চলিত ভাষারীতিও একটি অঞ্চলের কথ্য রীতির উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেবল- ভাগীরথী-তীরবর্তী অঞ্চলের কথ্য ভাষাকে তখন প্রমিত ভাষারীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, অন্যগুলোকে প্রমিত ভাষারীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
তবে আঞ্চলিক কথ্য রীতি লেখ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সেটি সর্বজনগ্রাহ্য নয়, সকল অঞ্চলের মানুষ কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা বুঝবে না। তবে কোনো অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কোনো সাহিত্য রচিত হলে সেখানে আঞ্চলিক ভাষা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। সম্পূর্ণ বা পুরোটুকুই আঞ্চলিক ভাষায় রচিত একটি শিল্পসম্মত উপন্যাস হলো হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’।