Search This Blog

সন্ধি (পর্ব ১): পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে। অর্থাৎ, এখানে দুটি ধ্বনির মিলন হবে, এবং সেই দুটি ধ্বনি পাশাপাশি অবস্থিত হবে। যেমন, ‘নর + অধম = নরাধম’। এখানে ‘নর’র শেষ ধ্বনি ‘অ’ (ন+অ+র+ অ), এবং ‘অধম’র প্রথম ধ্বনি ‘অ’। এখানে ‘অ’ ও ‘অ’ মিলিত হয়ে ‘আ’ হয়েছে। অর্থাৎ পাশাপাশি অবস্থিত দুইট ধ্বনি ‘অ’ ও ‘অ’ মিলিত হয়ে ‘আ’ হলো। সন্ধি ধ্বনির মিলন: সন্ধি নতুন শব্দ তৈরির একটি কৌশল, তবে এখানে সমাসের মতো নতুনভাবে সম্পূর্ণ শব্দ তৈরি হয় না। কেবল দুটো শব্দ মিলিত হওয়ার সময় পাশাপাশি অবস্থিত ধ্বনি দুটি মিলিত হয়। এই দুটি ধ্বনির মিলনের মধ্য দিয়ে দুটি শব্দ মিলিত হয়ে নতুন একটি শব্দ তৈরি করে। অর্থাৎ শব্দ দুটি মিলিত হয় না, ধ্বনি দুটি মিলিত হয়। উল্লেখ্য, একাধিক শব্দের বা পদের মিলন হলে তাকে বলে সমাস। সন্ধির উদ্দেশ্য: সন্ধি মূলত দুটো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করা হয়। সুতরাং যেখানে সন্ধির মাধ্যমে এই দুটি উদ্দেশ্যই পূরণ হবে, সেখানেই কেবল সন্ধি করা যাবে। এগুলো হলো- ১. সন্ধির ফলে উচ্চারণ আরো সহজ হবে (স্বাভাবিক উচ্চারণে সহজপ্রবণতা), ২. সন্ধি করার পর শুনতে আরো ভালো লাগবে (ধ্বনিগত মাধুর্য সম্পাদন) [সন্ধি পড়ার জন্যস্পর্শ বর্ণের তালিকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধ্বনি প্রকরণ ও উচ্চারণ বিধির অন্তর্গত তালিকাটি এখানে আবারো দেয়া হলো- নাম অঘোষ ঘোষ নাসিক্য অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ ক-বর্গীয় ধ্বনি (কণ্ঠ্য ধ্বনি) ক খ গ ঘ ঙ চ-বর্গীয় ধ্বনি (তালব্য ধ্বনি) চ ছ জ ঝ ঞ ট-বর্গীয় ধ্বনি (মূর্ধন্য ধ্বনি) ট ঠ ড ঢ ণ ত-বর্গীয় ধ্বনি (দন্ত্য ধ্বনি) ত থ দ ধ ন প-বর্গীয় ধ্বনি (ওষ্ঠ্য ধ্বনি) প ফ ব ভ ম সন্ধি প্রথমত ২ প্রকার- বাংলা শব্দের সন্ধি ও তৎসম সংস্কৃত শব্দের সন্ধি। বাংলা শব্দের সন্ধি খাঁটি বাংলা শব্দ বা তদ্ভব শব্দের যে সন্ধি, সেগুলোকেই বাংলা শব্দের সন্ধি বলে। বাংলা শব্দের সন্ধি ২ প্রকার- স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি। স্বরসন্ধি স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয়, তাকে বলে স্বরসন্ধি। বাংলা শব্দের স্বরসন্ধিতে দুটো সন্নিহিত স্বরের একটি লোপ পায়। যেমন, অ+এ = এ (অ লোপ) শত+এক = শতেক কত+এক = কতেক আ+আ = আ (একটা আ লোপ) শাঁখা+আরি =শাঁখারি রূপা+আলি = রূপালি আ+উ = উ (আ লোপ) মিথ্যা+উক = মিথ্যুক হিংসা+উক = হিংসুক নিন্দা+উক = নিন্দুক ই+এ = ই (এ লোপ) কুড়ি+এক = কুড়িক ধনি+ইক = ধনিক গুটি+এক = গুটিক আশি+এর = আশির ব্যঞ্জনসন্ধি স্বর আর ব্যঞ্জনে, ব্যঞ্জনে আর ব্যঞ্জনে এবং ব্যঞ্জনে আর স্বরধ্বনিতে যে সন্ধি হয়, তাকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে। খাঁটি বাংলা শব্দের ব্যঞ্জনসন্ধি মূলত ধ্বনি পরিবর্তনের সমীভবনের নিয়ম মেনে হয়। এবং ব্যঞ্জনসন্ধির ফলে সৃষ্ট শব্দগুলো মূলত কথ্যরীতিতেই সীমাবদ্ধ। [সমীভবন: দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির একে অপরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে সমতা লাভ করলে তাকে সমীভবন বলে। যেমন, ‘জন্ম’ (জ+অ+ন+ম+অ)-এর ‘ন’, ‘ম’-র প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে ‘জম্ম’। সমীভবন মূলত ৩ প্রকার- ক. প্রগত সমীভবন : আগের ব্যঞ্জনধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন। যেমন, চক্র˃ চক্ক, পক্ব˃ পক্ক, পদ্ম˃ পদ্দ, লগ্ন˃ লগ্গ, ইত্যাদি। খ. পরাগত সমীভবন : পরের ব্যঞ্জনধ্বনির প্রভাবে আগের ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন। যেমন, তৎ+জন্য˃ তজ্জন্য, তৎ+হিত˃ তদ্ধিত, উৎ+মুখ˃ উন্মুখ, ইত্যাদি। গ. অন্যোন্য সমীভবন : পাশাপাশি দুটো ব্যঞ্জনধ্বনি দুইয়ের প্রভাবে দু’টিই পরিবর্তিত হলে তাকে অন্যোন্য সমীভবন বলে। যেমন, সত্য (সংস্কৃত)˃ সচ্চ (প্রাকৃত), বিদ্যা (সংস্কৃত)˃ বিজ্জা (প্রাকৃত), ইত্যাদি।] ১. অঘোষ ধ্বনির পর ঘোষ ধ্বনি আসলে অঘোষ ধ্বনিটিও ঘোষ ধ্বনি হয়ে যাবে। যেমন, ছোট+দা = ছোড়দা। ২. হলন্ত র (র্) -এর পরে অন্য কোন ব্যঞ্জন ধ্বনি থাকলে ‘র্’ লুপ্ত হবে, পরবর্তী ব্যঞ্জনধ্বনি দ্বিত্ব হবে। যেমন, আর্+না = আন্না, চার্+টি = চাট্টি, ধর্+না = ধন্না, দুর্+ছাই = দুচ্ছাই ৩. ত-বর্গীয় ধ্বনির (ত, থ, দ, ধ, ন) পরে চ-বর্গীয় ধ্বনি (চ, ছ, জ, ঝ, ঞ) আসলে আগের ধ্বনি লোপ পায়, পরের ধ্বনি (চ-বর্গীয় ধ্বনি) দ্বিত্ব হয়। যেমন, নাত্+জামাই = নাজ্জামাই, বদ্+জাত = বজ্জাত, হাত+ছানি = হাচ্ছানি ৪. ‘প’ এর পরে ‘চ’ এলে আর ‘স’ এর পরে ‘ত’ এলে ‘চ’ ও ‘ত’ এর জায়গায় ‘শ’ হয়। যেমন, পাঁচ+শ = পাঁশশ, সাত+শ = সাশশ, পাঁচ+সিকা = পাঁশশিকা ৫. হলন্ত ধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনি যুক্ত হলে স্বরধ্বনিটি লোপ পাবে না। যেমন, বোন+আই = বোনাই, চুন+আরি = চুনারি, তিল+এক = তিলেক, বার+এক = বারেক, তিন+এক = তিনেক ৬. স্বরধ্বনির পরে ব্যঞ্জনধ্বনি এলে স্বরধ্বনিটি লুপ্ত হয়। যেমন, কাঁচা+কলা = কাঁচকলা, নাতি+বৌ = নাতবৌ, ঘোড়া+দৌড় = ঘোড়দৌড়, ঘোড়া+গাড়ি = ঘোড়গাড়ি তৎসম শব্দের সন্ধি তৎসম শব্দ অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষার যে সব শব্দ অবিকৃত অবস্থায় বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়, সে সব শব্দের যে সন্ধি হয়, তাকে বলে তৎসম শব্দের সন্ধি। মূলত সন্ধি বলতে এই তৎসম শব্দের সন্ধিকেই বোঝানো হয়। বাংলা ভাষায় ৩ ধরনের তৎসম শব্দের সন্ধি হয়- স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি। স্বরসন্ধি স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির সন্ধি হলে তাকে বলে স্বরসন্ধি। নিচে স্বরসন্ধির নিয়মগুলো দেয়া হলো- ১. ‘অ/আ’ এরপরে ‘অ/আ’ থাকলে উভয়ে মিলে ‘আ’ হয় এবং তা প্রথম ‘অ/আ’-র আগের ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়। অ+অ = আ নর+অধম = নরাধম প্রাণ+অধিক = প্রাণাধিক হিম+অচল = হিমাচল হস্ত+অন্তর = হস্তান্তর হিত+অহিত = হিতাহিত অ+আ = আ হিম+আলয় = হিমালয় দেব+আলয় = দেবালয় রত্ন+আকর = রত্নাকর সিংহ+আসন= সিংহাসন আ+অ = আ যথা+অর্থ = যথার্থ আশা+অতীত = আশাতীত মহা+অর্ঘ = মহার্ঘ কথা+অমৃত = কথামৃত আ+আ = আ বিদ্যা+আলয় = বিদ্যালয় কারা+আগার = কারাগার মহা+আশয় = মহাশয় সদা+আনন্দ = সদানন্দ