Search This Blog

সমাস (পর্ব ৩ ও শেষ পর্ব): প্রাদি সমাস প্র, প্রতি, অনু, পরি, ইত্যাদি অব্যয় বা উপসর্গের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় সাধিত বিশেষ্য বা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যর সমাস হলে তাকে প্রাদি সমাস বলে। যেমন, প্র (প্রকৃষ্ট) যে বচন = প্রবচন। এখানে বচন সমস্যমান পদটি একটি বিশেষ্য, যার মূল (ধাতু)বচ ধাতু বা কৃৎ প্রত্যয়। ‘প্র’ অব্যয়ের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় সাধিত বিশেষ্য ‘বচন’র সমাস হয়ে সমস্ত পদ ‘প্রবচন’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। সুতরাং, এটি প্রাদি সমাস। নিত্য সমাস যে সমাসের সমস্ত পদই ব্যাসবাক্যের কাজ করে, আলাদা করে ব্যাসবাক্য তৈরি করতে হয় না, তাকে নিত্য সমাস বলে। যেমন, অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর। এখানে ‘অন্য গ্রাম’ আর ‘গ্রামান্তর’, এই বাক্যাংশ ও শব্দটির মধ্যে তেমন বিশেষকোন পার্থক্য নেই। কেবল ‘অন্য’ পদের বদলে ‘অন্তর’ পদটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এটি নিত্য সমাস। ভাষা অনুশীলন; ১ম পত্র শকুন্তলা শব্দ ব্যাসবাক্য সমাসের নাম বনমধ্যে বনের মধ্যে ষষ্ঠী তৎপুরুষ প্রাণভয় প্রাণ যাওয়ার ভয় মধ্যপদলোপী কর্মধারয় রথারোহণ রথে আরোহণ সপ্তমী তৎপুরুষ রথচালন রথকে চালন দ্বিতীয় তৎপুরুষ শরনিক্ষেপ শরকে নিক্ষেপ দ্বিতীয় তৎপুরুষ শরের নিক্ষেপ ষষ্ঠী তৎপুরুষ প্রাণবধ প্রাণের বধ ষষ্ঠী তৎপুরুষ অতিমাত্র মাত্রাকে অতিক্রান্ত প্রাদি বেগসংবরণ বেগকে সংবরণ দ্বিতীয়া তৎপুরুষ বজ্রসম বজ্রের সম ষষ্ঠী তৎপুরুষ ক্ষীণজীবী ক্ষীণভাবে বাঁচে যে উপপদ তৎপুরুষ অল্পপ্রাণ অল্পপ্রাণ যার বহুব্রীহি পুত্রলাভ পুত্রকে লাভ দ্বিতীয়া তৎপুরুষ কার্যক্ষতি কার্যরে ক্ষতি ষষ্ঠী তৎপুরুষ অতিথি সৎকার অতিথির সৎকার ষষ্ঠী তৎপুরুষ ধর্মকার্য ধর্মবিহিত কার্য মধ্যপদলোপী কর্মধারয় ভুজবল ভুজের বল ষষ্ঠী তৎপুরুষ ভারার্পণ ভারের অর্পণ ষষ্ঠী তৎপুরুষ তপোবন তপের নিমিত্ত বন চতুর্থী তৎপুরুষ তপোবনদর্শন তপোবনকে দর্শন দ্বিতীয়া তৎপুরুষ কোটরস্থিত কোটরে স্থিত সপ্তমী তৎপুরুষ মুখভ্রষ্ট মুখ থেকে ভ্রষ্ট পঞ্চমী তৎপুরুষ উপলখণ্ড উপলের খণ্ড ষষ্ঠী তৎপুরুষ বিস্ময়াপন্ন বিস্ময়কে আপন্ন দ্বিতীয়া তৎপুরুষ কর্ণকুহর কর্ণের কুহর ষষ্ঠী তৎপুরুষ তপস্বিকন্যা তপস্বীর কন্যা ষষ্ঠী তৎপুরুষ অনতিবৃহৎ নয় অতি বৃহৎ নঞ তৎপুরুষ সেচনকলস সেচনের নিমিত্ত কলস চতুর্থী তৎপুরুষ জলসেচন জলদ্বারা সেচন তৃতীয়া তৎপুরুষ অনসূয়া নেই অসূয়া (ঈর্ষা) যার বহুব্রীহি প্রিয়ংবদা প্রিয়ম্ (প্রিয়বাক্য) বলে যে (স্ত্রী) উপপদ কণ্বতনয়া কণ্বের তনয়া ষষ্ঠী তৎপুরুষ মনোহারিণী মন হরণ করে যে নারী উপপদ তৎপুরুষ স্বভাবসিদ্ধ স্বভাব দ্বারা সিদ্ধ তৃতীয়া তৎপুরুষ অঙ্গুলি সংকেত অঙ্গুলি দ্বারা সংকেত তৃতীয়া তৎপুরুষ নবযৌবন নব যে যৌবন কর্মধারয় যৌবনের গান শব্দ ব্যাসবাক্য সমাসের নাম মমতারস মমতা মিশ্রিত রস মধ্যপদলোপী কর্মধারয় অলসতন্দ্রা অলস যে তন্দ্রা কর্মধারয় মোহনিদ্রা মোহ রূপ নিদ্রা রূপক কর্মধারয় সৈন্যসামন্ত সৈন্য ও সামন্ত দ্বন্দ্ব সংগীতগুঞ্জন সংগীতের গুঞ্জন ষষ্ঠী তৎপুরুষ ঝরনাধারা ঝরনার ধারা ষষ্ঠী তৎপুরুষ জবাকুসুমসঙ্কাশ জবাকুসুমের সঙ্কাশ ষষ্ঠী তৎপুরুষ তিমিরবিদারী তিমিরকে বিদীর্ণ করে যা কর্মধারয় যৌবনসূর্য যৌবন রূপ সূর্য রূপক কর্মধারয় তিমিরকুন্তলা তিমিরের ন্যায় কুন্তল যার উপমিত কর্মধারয় পাষাণস্তুপ পাষাণের স্তুপ ষষ্ঠী তৎপুরুষ আলোকপিয়াসী আলোকের পিয়াসী ষষ্ঠী তৎপুরুষ প্রাণচঞ্চল প্রাণ চঞ্চল যার বহুব্রীহি মেঘলুপ্ত মেঘে লুপ্ত সপ্তমী তৎপুরুষ জয়মুকুট জয়ের জন্য যে মুকুট মধ্যপদলোপী কর্মধারয় মার্তণ্ডপ্রায় মার্তণ্ডের প্রায় ষষ্ঠী তৎপুরুষ নবপৃথিবী নব যে পৃথিবী কর্মধারয় সলিলসমাধি সলিলে সমাধি সপ্তমী তৎপুরুষ একটি তুলসী গাছের কাহিনী শব্দ ব্যাসবাক্য সমাসের নাম গল্পপ্রেমিক গল্প প্রেমিক যে কর্মধারয় পুষ্পসৌরভ পুষ্পের সৌরভ ষষ্ঠী তৎপুরুষ জ্যোৎস্নারাত জ্যোৎস্না শোভিত রাত মধ্যপদলোপী কর্মধারয় পৃষ্ঠপ্রদর্শন পৃষ্ঠকে প্রদর্শন দ্বিতীয়া তৎপুরুষ দেশভঙ্গ দেশকে ভঙ্গ দ্বিতীয়া তৎপুরুষ জনমানব জন ও মানব দ্বন্দ্ব দেশপলাতক দেশ থেকে পলাতক পঞ্চমী তৎপুরুষ আম-কুড়ানো আমকে কুড়ানো দ্বিতীয়া তৎপুরুষ অনাশ্রিত নয় আশ্রিত যে বহুব্রীহি সমবেদনা-ভরা সমবেদনা দিয়ে ভরা তৃতীয়া তৎপুরুষ মন্দভাগ্য মন্দ যে ভাগ্য কর্মধারয় মন্দ ভাগ্য যার বহুব্রীহি ন্যায়সঙ্গত ন্যায় দ্বারা সঙ্গত তৃতীয়া তৎপুরুষ জীবনসঞ্চার জীবনের সঞ্চার ষষ্ঠী তৎপুরুষ আবর্জনা-ভরা আবর্জনা দ্বারা ভরা তৃতীয়া তৎপুরুষ গানের আসর গানের আসর অলুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ রান্নাঘর রান্না করা ঘর মধ্যপদলোপী কর্মধারয় রান্নার নিমিত্ত ঘর চতুর্থী তৎপুরুষ বেওয়ারিশ বে (নেই) ওয়ারিশ যার নঞর্থক বহুব্রীহি সন্ধ্যাপ্রদীপ সন্ধ্যার প্রদীপ ষষ্ঠী তৎপুরুষ জীবনপ্রদীপ জীবন রূপ প্রদীপ রূপক কর্মধারয় সুখসময় সুখের সময় ষষ্ঠী তৎপুরুষ গৃহকর্ত্রী গৃহের কর্ত্রী ষষ্ঠী তৎপুরুষ বাকবিতণ্ডা বাক দ্বারা বিতণ্ডা তৃতীয়া তৎপুরুষ অত্যাচার অবিচার অত্যাচার ও অবিচার দ্বন্দ্ব শ্বাস-প্রশ্বাস শ্বাস ও প্রশ্বাস দ্বন্দ্ব কচুকাটা কচুর মত কাটা উপমান কর্মধারয় অক্ষত নয় ক্ষত নঞ তৎপুরুষ অবিশ্বাস্য নয় বিশ্বাস্য নঞ তৎপুরুষ বেআইনি বে (নয়) আইনি নঞ তৎপুরুষ অপর্যাপ্ত নয় পর্যাপ্ত নঞ তৎপুরুষ যৌবনের গান শব্দ ব্যাসবাক্য সমাসের নাম শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন শ্রম-কিণাঙ্কের ন্যায় কঠিন উপমান কর্মধারয় বন্য-শ্বাপদ-সঙ্কুল বন্য-শ্বাপদে সঙ্কুল সপ্তমী তৎপুরুষ জরা-মৃত্যু-ভীষণা জরা-মৃত্যুতে ভীষণা সপ্তমী তৎপুরুষ ধরণী-মেরী ধরনী রূপ মেরী রূপক কর্মধারয় খেয়াল-খুশি খেয়াল ও খুশি দ্বন্দ্ব জীবন-আবেগ জীবনের আবেগ ষষ্ঠী তৎপুরুষ উদ্ধত-শির উদ্ধত শির যার বহুব্রীহি সিন্ধু-নীর সিন্ধুর নীর ষষ্ঠী তৎপুরুষ যৌবন-বেগ যৌবনের বেগ ষষ্ঠী তৎপুরুষ মরু-কবি মরুর কবি ষষ্ঠী তৎপুরুষ বিপ্লব-অভিযান বিপ্লব ও অভিযান দ্বন্দ্ব গরল-পিয়ালা গরলের পিয়ালা ষষ্ঠী তৎপুরুষ গিরি-নিঃস্রাব গিরি হতে নিঃসৃত যা বহুব্রীহি কূপমণ্ডুক কূপের মণ্ডুক ষষ্ঠী তৎপুরুষ

সমাস (পর্ব ২): কর্মধারয় সমাস মূলত ৪ প্রকার- মধ্যপদলোপী কর্মধারয়:যে কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তী পদগুলো লোপ পায়, তাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন, ‘স্মৃতি রক্ষার্থে সৌধ = স্মৃতিসৌধ’। এখানে ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তী পদ ‘রক্ষার্থে’ লোপ পেয়েছে। পূর্বপদ ‘স্মৃতি’ এখানে বিশেষণ ভাব বোঝাচ্ছে। আর ‘সৌধ’ বিশেষ্য। এটিরই অর্থ প্রধান। সুতরাং এটি মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। (উপমান ও উপমিত কর্মধারয় সমাস আলাদা করে চেনার আগে কতোগুলো সংজ্ঞা/ টার্মস জানা জরুরি। সেগুলো হলো- উপমান, উপমেয় ও সাধারণ ধর্ম।কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর সঙ্গে তুলনা করা হলে যাকে তুলনা করা হলো, তাকে বলা হয় উপমেয়। আর যার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে বলে উপমান। আর উপমেয় আর উপমানের যে গুণটি নিয়ে তাদের তুলনা করা হয়, সেই গুণটিকে বলা হয় সাধারণ ধর্ম। যেমন, ‘অরুণের ন্যায় রাঙা প্রভাত’। এখানে ‘প্রভাত’কে ‘অরুণ’র মতো ‘রাঙা’ বলে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং, এখানে ‘প্রভাত’ উপমেয়। উপমান হলো ‘অরুণ’। আর প্রভাত আর অরুণের সাধারণ ধর্ম হলো ‘রাঙা’।) উপমান কর্মধারয় সমাস:সাধারণ ধর্মবাচক পদের সঙ্গে উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। অর্থাৎ, উপমান ও উপমেয় কর্মধারয়ের মধ্যে যেটিতে সাধারণ ধর্মবাচক পদ থাকবে, সেটিই উপমান কর্মধারয়। যেমন, তুষারের ন্যায় শুভ্র = তুষারশুভ্র। এখানে ‘তুষার’র সঙ্গে কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে তুলনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ এটি উপমান। আর সাধারণ ধর্ম হলো ‘শুভ্র’। উপমেয় এখানে নেই। সুতরাং, এটি উপমান কর্মধারয় সমাস। উপমিত কর্মধারয় সমাস:উপমেয় ও উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। এই সমাসে সাধারণ ধর্ম উল্লেখ করা থাকে না। অর্থাৎ, উপমান ও উপমিত কর্মধারয়ের মধ্যে যেটিতে সাধারণ ধর্মবাচক পদ থাকবে না, সেটিই উপমিত কর্মধারয় সমাস। যেমন, ‘পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ’। এখানে ‘পুরুষ’কে ‘সিংহ’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ‘পুরুষ’ উপমেয় আর ‘সিংহ’ উপমান। সাধারণ ধর্মের উল্লেখ নেই। সুতরাং, এটি উপমিত কর্মধারয় সমাস। রূপক কর্মধারয় সমাস:উপমান ও উপমেয় পদের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করা হলে, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এটির ব্যাসবাক্যে উপমেয় ও উপমান পদের মাঝে ‘রূপ’ শব্দটি অথবা ‘ই’ শব্দাংশটি ব্যবহৃত হয়। যেমন, ‘মন রূপ মাঝি = মনমাঝি’। এখানে ‘মন’ উপমেয় ও ‘মাঝি’ উপমান। কিন্তু এখানে তাদের কোন নির্দিষ্ট গুণের তুলনা করা হয়নি। মনকেই মাঝি হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। তৎপুরুষ সমাস যে সমাসে পূর্বপদের শেষের বিভক্তি লোপ পায়, এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। পূর্বপদের যে বিভক্তি লোপ পায়, সেই বিভক্তি অনুযায়ী তৎপুরুষ সমাসের নামকরণ করা হয়। তবে মাঝে মাঝে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ না পেয়ে অবিকৃত থেকে যায়। তখন সেটাকে বলা হয় অলুক তৎপুরুষ। (অলুক মানে লোপ না পাওয়া, অ-লোপ)। যেমন, দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত। এখানে পূর্বপদ ‘দুঃখ’র সঙ্গে থাকা দ্বিতীয়া বিভক্তি ‘কে’ লোপ পেয়েছে। আবার পরপদ ‘প্রাপ্ত’র অর্থই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখ প্রাপ্ত হয়েছে বলেই নতুন শব্দের প্রয়োজন হয়েছে, যার জন্য বাক্যাংশটিকে সমাস করে নতুন শব্দ বানানো হয়েছে। অর্থাৎ, এখানে পূর্বপদের শেষের বিভক্তি লোপ পেয়েছে, এবং পরপদের অর্থের প্রাধান্য রক্ষিত হয়েছে। তাই এটি তৎপুরুষ সমাস। বহুব্রীহি সমাস যে সমাসে পূর্বপদ বা পরপদ কোনটিরই অর্থের প্রাধান্য রক্ষিত হয় না, বরং সমস্ত পদ তৃতীয় কোন শব্দকে বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন, মহান আত্মা যার = মহাত্মা। এখানে পূর্বপদ ‘মহান’ (মহা) ও পরপদ ‘আত্মা’। কিন্তু সমস্ত পদ ‘মহাত্মা’ দ্বারা মহান বা আত্মা কোনটাকেই না বুঝিয়ে এমন একজনকে বোঝাচ্ছে, যিনি মহান, যার আত্মা বা হৃদয় মহৎ। আবার, মহাত্মা বলতে মহাত্মা গান্ধীকেও বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু কোন অর্থেই পূর্বপদ বা পরপদকে বোঝানো হচ্ছে না। অর্থাৎ, পূর্বপদ বা পরপদ, কোনটারই অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে না। সুতরাং, এটি বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ। (উল্লেখ্য, বহুব্রীহি সমাস, বিশেষ করে কিছু ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস ও উপপদ তৎপুরুষ সমাসের সমস্ত পদ প্রায় একই ধরনের হয়। ফলে এদের সমস্ত পদ দেখে আলাদা করে চেনার তেমন কোন উপায় নেই। এগুলোর সমাস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাই একই ব্যাসবাক্য ও সমাস নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর পরীক্ষায় মূলত এগুলো উপপদ তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ হিসেবেই আসে।) দ্বিগু সমাস দ্বিগু সমাসের সঙ্গে কর্মধারয় সমাসের বেশ মিল রয়েছে। এজন্য একে অনেকেই কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভূক্ত করে থাকেন। দ্বিগু সমাসেও পরপদের অর্থই প্রধান। এবং এই সমাসেও বিশেষণ পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের সমাস হয়। তবে এখানে বিশেষণ পদটি সর্বদাই সংখ্যাবাচক হয়, এবং সমাস হয় সমাহার বা মিলন অর্থে। অর্থাৎ, সমাহার বা মিলন অর্থে সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয়, এবং পরপদের অর্থই প্রাধান্য পায়, তাকে দ্বিগু সমাস বলে। যেমন, ‘অষ্ট ধাতুর সমাহার = অষ্টধাতু’। এখানে পূর্বপদ ‘অষ্ট’ একটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ। আর পরপদ ‘ধাতু’ বিশেষ্য। অষ্ট ধাতুর মিলন বা সমাহার অর্থে সমাস হয়ে ‘অষ্টধাতু’ সমস্ত পদটি তৈরি হয়েছে যাতে ‘ধাতু’ সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, পরপদের অর্থ প্রধান হিসেবে দেখা দিয়েছে। সুতরাং, এটি দ্বিগু সমাস। অব্যয়ীভাব সমাস সমাসের পূর্বপদ হিসেবে যদি অব্যয় পদ ব্যবহৃত হয়, এবং সেই অব্যয়ের অর্থই প্রধান হয়, তবে সেই সমাসকে বলা হয় অব্যয়ীভাব সমাস। যেমন, ‘মরণ পর্যন্ত = আমরণ’। এখানে পূর্বপদ হিসেবে পর্যন্ত অর্থে ‘আ’ উপসর্গ ব্যবহৃত হয়েছে। আর পরপদ ‘মরণ’। কিন্তু এখানে সমস্ত পদটিকে নতুন অর্থ দিয়েছে ‘আ’ উপসর্গটি। অর্থাৎ, এখানে ‘আ’ উপসর্গ বা অব্যয় বা পূর্বপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এটি অব্যয়ীভাব সমাস। (উপসর্গ এক ধরনের অব্যয়সূচক শব্দাংশ। উপসর্গ বচন বা লিঙ্গ ভেদে পরিবর্তিত হয় না কিংবা বাক্যের অন্য কোন পদের পরিবর্তনেও এর কোন পরিবর্তন হয় না। এরকম আরেকটি অব্যয়সূচক শব্দাংশ হলো অনুসর্গ।)

সমাস (পর্ব ১): সমাস ব্যাসবাক্য সমস্ত পদ সমস্যমান পদ পূর্বপদ পরপদ/ উত্তরপদ প্রকারভেদ অর্থ প্রাধান্যের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ দ্বন্দ্ব সমাস কর্মধারয় সমাস কর্মধারয় সমাসের কয়েকটি বিশেষ নিয়ম মধ্যপদলোপী কর্মধারয় উপমেয় উপমান সাধারণ ধর্ম উপমান কর্মধারয় সমাস উপমিত কর্মধারয় সমাস রূপক কর্মধারয় সমাস তৎপুরুষ সমাস বহুব্রীহি সমাস দ্বিগু সমাস অব্যয়ীভাব সমাস প্রাদি সমাস নিত্য সমাস ভাষা অনুশীলন; ১ম পত্র শকুন্তলা যৌবনের গান একটি তুলসী গাছের কাহিনী যৌবনের গান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত বছরের প্রশ্ন সমাস:সমাস শব্দের অর্থ মিলন। অর্থ সম্বন্ধ আছে এমন একাধিক শব্দের মিলিত হয়ে একটি নতুন শব্দ তৈরির ব্যাকরণ সম্মত প্রক্রিয়াকেই বলা হয় সমাস। মূলত, সমাসে একটি বাক্যাংশ একটি শব্দে পরিণত হয়। সমাসের রীতি বাংলায় এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। বাক্যে শব্দের ব্যবহার কমানোর উদ্দেশ্যে সমাস ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, সমাস অর্থ সম্বন্ধপূর্ণ একাধিক শব্দের মিলন। আর সন্ধি পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি ধ্বনির মিলন। সমাসের জন্য কয়েকটি সংজ্ঞা/ টার্মস জানা খুবই জরুরি। এগুলো হলো- ব্যাসবাক্য: যে বাক্যাংশ থেকে সমাসের মাধ্যমে নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলা হয় ব্যাসবাক্য। একে সমাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্যও বলা হয়। সমস্ত পদ:ব্যাসবাক্য থেকে সমাসের মাধ্যমে যে নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলা হয় সমস্ত পদ। সমস্যমান পদ:ব্যাসবাক্যের যে সব শব্দ সমস্ত পদে অন্তর্গত থাকে, সমস্ত পদের সেই সব শব্দকে সমস্যমান পদ বলে। পূর্বপদ : সমস্ত পদের প্রথম অংশ/ শব্দকে পূর্বপদ বলে। অর্থাৎ, সমস্ত পদের প্রথম সমস্যমান পদই পূর্বপদ। পরপদ/ উত্তরপদ:সমস্ত পদের শেষ অংশ/ শব্দকে পরপদ/ উত্তরপদ বলে। অর্থাৎ, সমস্ত পদের শেষ সমস্যমান পদই পরপদ। যেমন, সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন এখানে ব্যাসবাক্য হলো- ‘সিংহ চিহ্নিত আসন’। আর সমস্ত পদ হলো ‘সিংহাসন’। সমস্যমান পদ হলো ‘সিংহ’ আর ‘আসন’। এদের মধ্যে ‘সিংহ’ পূর্বপদ, আর ‘আসন’ পরপদ। আবার, আমিষের অভাব = নিরামিষ এখানে, পূর্বপদ ‘নিঃ’ বা অভাব। আর পরপদ হলো ‘আমিষ’। উলেলখ্য, একই সমস্ত পদ কয়েকভাবে ভেঙে কয়েকটি ব্যাসবাক্য তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সঠিক ব্যাসবাক্যও কয়েকটি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাসবাক্য অনুযায়ী সেটি কোন সমাস তা নির্ণয় করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ব্যাসবাক্যের সঙ্গে সমস্ত পদের অর্থসঙ্গতি যেন ঠিক থাকে। যেমন, ‘বিপদে আপন্ন = বিপদাপন্ন’, এই সমাসটি এভাবে ভাঙলে তা ভুল হবে। এটা করতে হবে ‘বিপদকে আপন্ন = বিপদাপন্ন’। প্রকারভেদ:সমাসপ্রধানত ৬ প্রকার- দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, দ্বিগু ও অব্যয়ীভাব। তবে অনেকেই দ্বিগু সমাসকে কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভূক্ত করে থাকেন। আবার অনেকে কর্মধারয় সমাসকে তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভূক্ত করে থাকেন। সমস্যমান পদের অর্থ প্রাধান্য বিবেচনা করে তারা এই মত দিয়ে থাকেন।সমস্যমান পদ বা পূর্বপদ-পরপদের অর্থ প্রাধান্য বিবেচনা করলে মূলত সমাস ৪ প্রকার- দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব। এছাড়াও কিছু অপ্রধান সমাসও রয়েছে। যেমন- প্রাদি, নিত্য, অলুক, প্রভৃতি। অর্থ প্রাধান্যের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ : পূর্বপদের অর্থ প্রাধান্য পরপদের অর্থ প্রাধান্য সমাস আছে আছে দ্বন্দ্ব নেই আছে কর্মধারয়, তৎপুরুষ, দ্বিগু আছে নেই অব্যয়ীভাব নেই নেই বহুব্রীহি নিচে বিভিন্ন সমাসের বর্ণনা দেয়া হলো। দ্বন্দ্বসমাস যে সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ- উভয়েরই অর্থের প্রাধান্য থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। এই সমাসে ব্যাসবাক্যে পূর্বপদ ও পরপদের সম্বন্ধ স্থাপনে ও, এবং, আর- এই তিনটি অব্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন- মা ও বাপ = মা-বাপ। এখানে পূর্বপদ ‘মা’ ও পরপদ ‘বাপ’। ব্যাসবাক্যে ‘মা’ ও ‘বাপ’ দুইজনকেই সমান প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, এবং দুজনকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, পূর্বপদ ও পরপদ, উভয়েরই অর্থের প্রাধান্য রক্ষিত হয়েছে। তাই এটি দ্বন্দ্ব সমাস। কর্মধারয় সমাস কর্মধারয় সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়। মূলত, এই সমাসে বিশেষণ বা বিশেষণ ভাবাপন্ন পদ পূর্বপদ ও বিশেষ্য বা বিশেষ্য ভাবাপন্ন পদ পরপদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর ব্যাসবাক্যটিতে ঐ বিশেষ্য বা বিশেষ্য ভাবাপন্ন পদটি সম্পর্কে কিছু বলা হয়। অর্থাৎ পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়। যেমন- নীল যে পদ্ম = নীলপদ্ম। এখানে, পূর্বপদ ‘নীল’ বিশেষণ ও পরপদ ‘পদ্ম’ বিশেষ্য। ব্যাসবাক্যে ‘পদ্ম’ সম্পর্কে বলা হয়েছে পদ্মটি ‘নীল’ রঙের। অর্থাৎ, ‘পদ্ম’ বা পরপদের অর্থই এখানে প্রধান, পরপদ ছাড়া পূর্বপদের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই এটি কর্মধারয় সমাস। কর্মধারয় সমাসের কয়েকটি বিশেষ নিয়ম- *.দুইটি বিশেষণ একই বিশেষ্য বোঝালে সেটি কর্মধারয় সমাস হয়। যেমন, যে চালাক সেই চতুর = চালাক-চতুর। এখানে পরবর্তী বিশেষ্যটি অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে এটি দ্বন্দ্ব সমাস হবে না। *.দুইটি বিশেষ্য একই ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝালে সেটিও কর্মধারয় সমাস হয়। যেমন, যিনি জজ তিনি সাহেব = জজসাহেব। একই কারণে এটি দ্বন্দ্ব না কর্মধারয় হবে। *.কার্যে পরপম্পরা বোঝাতে দুটি কৃদন্ত বিশেষণ বা ক্রিয়াবাচক বিশেষণ পদেও কর্মধারয় সমাস হয়। যেমন, আগে ধোয়া পরে মোছা = ধোয়ামোছা। এখানে ‘মোছা’ কাজটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। *.পূর্বপদে স্ত্রীবাচক বিশেষণ থাকলে তা পুরুষবাচক হয়ে যাবে। যেমন, সুন্দরী যে লতা = সুন্দরলতা *.বিশেষণবাচক মহান বা মহৎ শব্দ পূর্বপদ হলে মহা হয়। মহৎ যে জ্ঞান = মহাজ্ঞান *.পূর্বপদে ‘কু’ বিশেষণ থাকলে এবং পরপদের প্রথমে স্বরধ্বনি থাকলে ‘কু’, ‘কৎ’ হয়। যেমন, কু যে অর্থ = কদর্থ। *.পরপদে ‘রাজা’ থাকলে ‘রাজ’ হয়। যেমন, মহান যে রাজা = মহারাজ। *.বিশেষণ ও বিশেষ্য পদে কর্মধারয় সমাস হলে কখনো কখনো বিশেষ্য আগে এসে বিশেষণ পরে চলে যায়। যেমন, সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ।

শব্দের শ্রেণীবিভাগ (পর্ব ২ ও শেষ পর্ব): এছাড়াও আরেকটি বিশেষ ধরনের শব্দ আছে। দুইটি ভিন্ন ধরনের শব্দ সমাসবদ্ধ হয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে একত্রিত হলে ঐ নতুন শব্দটিকে বলা হয়মিশ্র শব্দ। এক্ষেত্রে যে দুইটি শব্দ মিলিত হলো, তাদের শ্রেণীবিভাগ চিনতে পারাটা খুব জরুরি। যেমন- রাজা-বাদশা (তৎসম+ফারসি) হাট-বাজার (বাংলা+ফারসি) হেড-মৌলভী (ইংরেজি+ফারসি) হেড-পন্ডিত (ইংরেজি+তৎসম) খ্রিস্টাব্দ (ইংরেজি+তৎসম) ডাক্তারখানা (ইংরেজি+ফারসি) পকেট-মার (ইংরেজি+বাংলা) চৌ-হদ্দি (ফারসি+আরবি) শব্দের গঠনমূলক শ্রেণীবিভাগ গঠন অনুসারে শব্দ ২ প্রকার- মৌলিক শব্দ:যে সব শব্দকে বিশ্লেষণ করলে আর কোন শব্দ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। অর্থাৎ, যে সব শব্দকে ভাঙলে আর কোন অর্থসঙ্গতিপূর্ণ শব্দ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন- গোলাপ, নাক, লাল, তিন, ইত্যাদি। এই শব্দগুলোকে আর ভাঙা যায় না, বা বিশ্লেষণ করা যায় না। আর যদি ভেঙে নতুন শব্দ পাওয়াও যায়, তার সঙ্গে শব্দটির কোন অর্থসঙ্গতি থাকে না। যেমন, উদাহরণের গোলাপ শব্দটি ভাঙলে গোল শব্দটি পাওয়া যায়। কিন্তু গোলাপ শব্দটি গোল শব্দ থেকে গঠিত হয়নি। এই দুটি শব্দের মাঝে কোন অর্থসঙ্গতিও নেই। তেমনি নাক ভেঙে না বানানো গেলেও নাক না থেকে আসেনি। অর্থাৎ, এই শব্দগুলোই মৌলিক শব্দ। ‘গোলাপ’ শব্দটির সঙ্গে ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করে আমরা ‘গোলাপী’ শব্দটি বানাতে পারি। তেমনি ‘নাক’-র সঙ্গে ‘ফুল’ শব্দটি যোগ করে আমরা ‘নাকফুল’ শব্দটি গঠন করতে পারি। সাধিত শব্দ:যে সব শব্দকে বিশ্লেষণ করলে অর্থসঙ্গতিপূর্ণ ভিন্ন একটি শব্দ পাওয়া যায়, তাদেরকে সাধিত শব্দ বলে। মূলত, মৌলিক শব্দ থেকেই বিভিন্ন ব্যাকরণসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় সাধিত শব্দ গঠিত হয়। মৌলিক শব্দ সমাসবদ্ধ হয়ে কিংবা প্রত্যয় বা উপসর্গ যুক্ত হয়ে সাধিত শব্দ গঠিত হয়। যেমন- সমাসবদ্ধ হয়ে- চাঁদের মত মুখ = চাঁদমুখ প্রত্যয় সাধিত- ডুব+উরি = ডুবুরি উপসর্গযোগে- প্র+শাসন = প্রশাসন অর্থমূলক শ্রেণীবিভাগ শব্দের অর্থমূলক শ্রেণীবিভাগ জানার আগে শব্দেরব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থসম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা দরকার। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:কোন শব্দ যে শব্দ বা শব্দমূল হতে গঠিত হয়েছে তার অর্থ দিয়ে শব্দটির যে অর্থ ধারণ করার কথা, তাকে শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বলে। অর্থাৎ, উৎপত্তিগত ভাবে শব্দটির যে অর্থ দাঁড়ায়, তাকেই ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বলে। যেমন, ‘মধুর’ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘মধু+র’ অর্থাৎ ‘মধু’ শব্দ হতে। তাই ‘মধুর’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হওয়া উচিত মধু সংশ্লিষ্ট কোন অর্থ। আর ‘মধুর’ শব্দের অর্থ ‘মধুর মত মিষ্টি গুণযুক্ত’। অর্থাৎ, ‘মধুর’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বজায় থেকেছে। আবার, ‘হস্তী’ শব্দটি গঠিত হয়েছে ‘হস্ত+ইন’ অর্থাৎ ‘হস্ত’ শব্দ হতে। তাই ‘হস্তী’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হওয়া উচিত হস্ত বা হাত সংশ্লিষ্ট। কিন্তু ‘হস্তী’ বলতে একটি বিশেষ পশুকে বোঝায়, যার আদপে কোন হাত-ই নেই। অর্থাৎ, শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বজায় থাকেনি। ব্যবহারিক অর্থ:কোন শব্দ প্রকৃতঅর্থে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, বা যে অর্থ প্রকাশ করে, তাকে সেই শব্দের ব্যবহারিক অর্থ বলে। যেমন, উপরের উদাহরণগুলোতে, ‘মধুর’ শব্দটির ব্যবহারিক অর্থ ‘মধুর মত মিষ্টি গুণযুক্ত’, আর ‘হস্তী’র ব্যবহারিক অর্থ ‘একটি বিশেষ পশু’। অর্থগত ভাবে শব্দসমূহকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়- যৌগিক শব্দ:যে সব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ একই, তাদের যৌগিক শব্দ বলে। অর্থাৎ, শব্দগঠনের প্রক্রিয়ায় যাদের অর্থ পরিবর্তিত হয় না, তাদেরকে যৌগিক শব্দ বলে। যেমন- মূল শব্দ শব্দ গঠন (অর্থ) অর্থ গায়ক গৈ+অক যে গান করে কর্তব্য কৃ+তব্য যা করা উচিত বাবুয়ানা বাবু+আনা বাবুর ভাব মধুর মধু+র মধুর মত মিষ্টি গুণযুক্ত দৌহিত্র দুহিতা+ষ্ণ্য (দুহিতা= মেয়ে, ষ্ণ্য= পুত্র) কন্যার মত, নাতি চিকামারা চিকা+মারা দেওয়ালের লিখন রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ:প্রত্যয় বা উপসর্গযোগে গঠিত যে সব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ব্যবহারিক অর্থ আলাদা হয়, তাদেরকে রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। যেমন- মূল শব্দ শব্দ গঠন ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ব্যবহারিক/ মূল অর্থ হস্তী হস্ত+ইন ব্যাপক অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা বাঁশি বাঁশ+ইন বাঁশ দিয়ে তৈরি বাঁশের তৈরি বিশেষ বাদ্যযন্ত্র তৈল তিল+ষ্ণ্য তিল থেকে তৈরি সেণহ পদার্থ উদ্ভিদ থেকে তৈরি যে কোন সেণহ পদার্থ প্রবীণ প্র+বীণা প্রকৃষ্টরূপে বীণা বাজায় যিনি অভিজ্ঞ বয়স্ক ব্যক্তি সন্দেশ সম+দেশ সংবাদ মিষ্টান্ন বিশেষ যোগরূঢ় শব্দ:সমাসনিষ্পন্ন যে সব শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আর ব্যবহারিক অর্থ আলাদা হয়, তাদেরকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। যেমন- মূল শব্দ শব্দ গঠন ব্যবহারিক অর্থ পঙ্কজ পঙ্কে জন্মে যা পদ্মফুল রাজপুত রাজার পুত্র একটি জাতি বিশেষ, ভারতের একটি জাতি মহাযাত্রা মহাসমারোহে যাত্রা মৃত্যু জলধি জল ধারণ করে যা/ এমন সাগর ]৪.নবসৃষ্ট বা পরিশব্দ বা পারিভাষিক শব্দ:বিভিন্ন বিদেশি শব্দের অনুকরণে ভাবানুবাদমূলক যেসব প্রতিশব্দ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেগুলোকে নবসৃষ্ট বা পরিশব্দ বা পারিভাষিক শব্দ বলে। মূলত প্রচলিত বিদেশি শব্দেরই এরকম পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। যেমন- পারিভাষিক শব্দ মূল বিদেশি শব্দ পারিভাষিক শব্দ মূল বিদেশি শব্দ অম্লজান Oxygen সচিব Secretary উদযান Hudrogen স্নাতক Graduate নথি File স্নাতকোত্তর Post Graduate প্রশিক্ষণ Training সমাপ্তি Final ব্যবস্থাপক Manager সাময়িকী Periodical বেতার Radio সমীকরণ Equation মহাব্যবস্থাপক General Manager [কিন্তু,যেসব বিদেশি শব্দ আমাদের ভাষায় প্রচলিত হয়ে গেছে, আমাদের ভাষায় ঢুকে গেছে, সেগুলোও বাংলা ভাষার শব্দ; সেই শব্দগুলোও আমাদের ভাষার সম্পদ। সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার একটি সমৃদ্ধ ভাষার সবচেয়ে বড়ো লক্ষণ। যে ভাষার শব্দভাণ্ডার যতো বড়ো, সেই ভাষা ততো বেশি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষা। আর শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির একটি প্রধান কৌশল বিদেশি শব্দ আত্মীকরণ বা গ্রহণ।আর তাই বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক কঠিনতর পরিভাষা তৈরি করা নিষ্প্রয়োজন। এবং তা সাধারণ মানুষ গ্রহণও করে না। ভাষায় তা-ই টিকে থাকে, যা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে।

শব্দের শ্রেণীবিভাগ (পর্ব ১): শব্দের উৎপত্তিগত শ্রেণীবিভাগ বাংলা ভাষার উৎপত্তি তৎসম শব্দ অর্ধ-তৎসম শব্দ তদ্ভব শব্দ দেশি শব্দ বিদেশি শব্দ আরবি শব্দ ফারসি শব্দ ইংরেজি শব্দ পর্তুগিজ শব্দ ফরাসি শব্দ ওলন্দাজ শব্দ গুজরাটি শব্দ পাঞ্জাবি শব্দ তুর্কি শব্দ চিনা শব্দ মায়ানমার/ বর্মি শব্দ জাপানি শব্দ মিশ্র শব্দ শব্দের গঠনমূলক শ্রেণীবিভাগ মৌলিক শব্দ সাধিত শব্দ অর্থমূলক শ্রেণীবিভাগ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ব্যবহারিক অর্থ যৌগিক শব্দ রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ যোগরূঢ় শব্দ নবসৃষ্ট বা পরিশব্দ বা পারিভাষিক শব্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত বছরের প্রশ্ন শব্দের উৎপত্তিগত শ্রেণীবিভাগ বাংলা ভাষার শব্দকে উৎপত্তিগত দিক দিয়ে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ৫টি বিভাজন সম্পর্কে জানার আগে বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য জানা জরুরি। বাংলা ভাষার উৎপত্তি:বাংলা ভাষার উৎপত্তি মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে। এই বংশের অন্যতম একটি শাখা সংস্কৃত। বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার বংশেরই উত্তরসূরী। কিন্তু বাংলা ভাষা সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে আসেনি। সংস্কৃত সবসময়েই ছিলো সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষদের ব্যবহৃত ভাষা। আর বাংলা শুরু থেকেই সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের ভাষা। এ থেকেই বোঝা যায় সংস্কৃত আর বাংলার মাঝেও কোনো ভাষা ছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাষাবিদেরা একমত হতে পারেননি। পূর্বে সম্ভ্রান্ত মানুষেরা সংস্কৃত ব্যবহার করতো। আর সাধারণ মানুষ যে সব ভাষায় কথা বলতো, সেগুলোকে বলা হতো প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষা। অপভ্রংশ মানে বিকৃত, সংস্কৃত ভাষার শব্দকে মানুষ পরিবর্তন করে তাদের সুবিধামতো করে উচ্চারণ করতো বলে এগুলোকে পন্ডিতরা বলতেন অপভ্রংশ বা বিকৃত ভাষা। এগুলো আঞ্চলিক ভাষার মতোই একেক জায়গায় ছিলো একেক রকম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা এসেছে গৌড়ীয় প্রাকৃত বা অপভ্রংশ থেকে। আর ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলা এসেছে মাগধী অপভ্রংশ থেকে। এই অপভ্রংশগুলোতে সংস্কৃত ভাষার যে পরিবর্তিত বা বিকৃত রূপ পাওয়া যায়, তারই আরো পরিবর্তিত আর সহজ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় বাংলা ভাষা। দিন দিন মানুষের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা ভাষাও অনেক সহজ হয়ে এসেছে। এবং তা আরো পরিবর্তিত হয়ে দিন দিন আরো সহজ ও সংক্ষিপ্ত হবে। পাশাপাশি নতুন নতুন প্রয়োজনে আরো অনেক নতুন শব্দও তৈরি হবে বা অন্য ভাষা থেকে আমাদের ভাষায় ঢুকে যাবে। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে শব্দের ৫টি বিভাজন হলো- তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি আর বিদেশি শব্দ। তৎসম শব্দ:সংস্কৃত ভাষার যে সব শব্দ প্রাকৃত বা অপভ্রংশের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়নি, বরং সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সে সব শব্দকেই বলা হয় তৎসম শব্দ। উদাহরণ- চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, অনেক তৎসম শব্দেরই অর্ধ-তৎসম ও তদ্ভব রূপও বাংলায় ব্যবহৃত হয়। যেমন, সূর্য˃ সুরুয, মনুষ্য˃ মানুষ। শুধু তৎসম শব্দেই ষ, ণ ব্যবহৃত হয়। অর্ধ-তৎসম শব্দ:যে সব সংস্কৃত শব্দ কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম। এগুলো সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকেই কিছুটা সহজ আকারে গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষার মাধ্যমে বাংলায় আসেনি। যেমন, জ্যোৎস্না˂ জ্যোছনা, শ্রাদ্ধ˂ ছেরাদ্দ, গৃহিণী˂ গিন্নী, বৈষ্ণব˂ বোষ্টম, কুৎসিত˂ কুচ্ছিত। তদ্ভব শব্দ:বাংলা ভাষা গঠনের সময় প্রাকৃত বা অপভ্রংশ থেকে যে সব শব্দ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছিলো, সেগুলোকেই বলা হয় তদ্ভব শব্দ। অবশ্য, তদ্ভব শব্দের মূল অবশ্যই সংস্কৃত ভাষায় থাকতে হবে। অর্থাৎ, যে সব শব্দ সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃত বা অপভ্রংশে ব্যবহৃত হয়েছিলো, পরে আবার প্রাকৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকেই বলা হয় তদ্ভব শব্দ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস থেকেই বোঝা যায়, মূলত এই শব্দগুলোই বাংলা ভাষা গঠন করেছে। আর তাই এই শব্দগুলোকে বলা হয় খাঁটি বাংলা শব্দ। যেমন, সংস্কৃত ‘হস্ত’ শব্দটি প্রাকৃততে ‘হত্থ’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর বাংলায় এসে সেটা আরো সহজ হতে গিয়ে হয়ে গেছে ‘হাত’। তেমনি, চর্মকার˂ চম্মআর˂ চামার, দেশি শব্দ:বাংলা ভাষাভাষীদের ভূখণ্ডে অনেক আদিকাল থেকে যারা বাস করতো, সেইসব আদিবাসীদের ভাষার যে সব শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সে সব শব্দকে বলা হয় দেশি শব্দ। এই আদিবাসীদের মধ্যে আছে- কোল, মুণ্ডা, ভীম, ইত্যাদি। মেমন,কুড়ি (বিশ)- কোলভাষা, পেট (উদর)- তামিল ভাষা, চুলা (উনুন)- মুণ্ডারী ভাষা। বিদেশি শব্দ:বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা অন্য ভাষাভাষীর মানুষের সংস্পর্শে এসে তাদের ভাষা থেকে যে সব শব্দ গ্রহণ করেছে, বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে অন্য ভাষার শব্দ গৃহীত হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় বিদেশি শব্দ। যে কোনো ভাষার সমৃদ্ধির জন্য বিদেশি শব্দের আত্মীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এদিক দিয়ে বাংলা ভাষা বেশ উদারও বটে। আরবি শব্দ :আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওযু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গোসল, জান্নাত, জাহান্নাম, হওবা, হসবি, যাকাত, হজ, হাদিস, হারাম, হালাল আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মোক্তার, রায় ফারসি শব্দ:খোদা, গুনাহ, দোযখ, নামায, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রোযা কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান,দস্তখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, মেথর, রসদ আদমি, আমদানি, জানোয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাস, রফতানি, হাঙ্গামা ইংরেজি শব্দ: প্রায় অপরিবর্তিত উচ্চারণে- চেয়ার, টেবিল পরিবর্তিত উচ্চারণে- আফিম (opium), ইস্কুল (school), বাক্স (box), হাসপাতাল (hospitai), বোতল (bottle) পর্তুগিজ শব্দ :আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি ফরাসি শব্দ : কার্তুজ, কুপন , ডিপো, রেস্তোঁরা ওলন্দাজ শব্দ : ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন (তাসের নাম) গুজরাটি শব্দ : খদ্দর, হরতাল পাঞ্জাবি শব্দ : চাহিদা, শিখ তুর্কি শব্দ : চাকর, চাকু, তোপ, দারোগা চিনা শব্দ : চা, চিনি, লুচি মায়ানমার/ বর্মি শব্দ : ফুঙ্গি, লুঙ্গি জাপানি শব্দ :রিক্সা, হারিকিরি